Friday, December 14, 2018

প্রতীক্ষা শেষ হয়নি (Pratiksha Sesh hoi ni... Poem)

Poem, love, bengali kabita

তুমি যাবে কি আমার সাথে...

যেখানে আকাশ নীল, তৎপর সাগর,
রৌদ্রস্নাত মেঘ,
ভাসমান নিজ স্বপনে..
যেখানে সরল সুবাস, হিল্লোলিত কানন,
আকন্ঠ সতেজ,
লালায়িত নিজ গঠনে।

আনন্দের ফাটক খোলা দেখ,
হাতের পরশ হয়নি এখনও ম্লান,
হয়নিতো কিছুই শুরু, তোমারিতো সময় নেই,
এবার তুমি যাবে কি আমার সাথে...

যেখানে বাঁধনে জড়ায় না কেউ,
অপরুপ প্রকৃতির ঢেউ,
যেখানে অসীম প্রেম, মাদল তোলে,
বহুরঙ্গ করতালি,
বিয়পে বহু নীরব কল্লোলে।
অসমতল রঙ্গিন প্রাকারে, আমি আছি,
তোমার অপেক্ষায়।।




Monday, December 10, 2018

সন্ধিক্ষণের নিশ্বাস ( Sandikhoner nissas-poem)


এক মুষ্টি বদ্ধ স্বপ্ন,
তার সাথে এমনই বড় হয়ে ওঠা,
বধির সুখের আওতা ছেরে, 
অসুরের ডাকে ছুটি আপ্রান, 
বাহিরে এই রন প্রাঙ্গণে।

Poem, old days, past, memory


স্বপ্ন বড়ই রঙ্গিন,
পেছন ফিরলে সিঁড়ির পাহাড়,
আজ তথাপিও বড় ক্লান্ত,
আরও চাই, চেয়েই যাই,
চাহিদার কোথায় আছে শেষ,
আজও তা জানা নাই।

একমাত্র নবজন্মা শিশুটিই বড় শান্ত,
বাকিরা আসরে নিযুক্ত সবাই নাটকে ব্যাস্ত,
সবাই বড়ই উন্মাদ, বড়ই অশান্ত,
ঈচ্ছেপূরনের যেন আদি অন্ত নেই,
ঊর্ধশ্বাসে হাজার রোগ বিন্যাসে,
ছুটে চলেছি পারাপার।


অনন্তের টান (Ononter Tan- poem)

Poem, recitation, new born

নবজাতিকার কান্নায় প্রস্ফুটিত ধরাধাম,
মনপর্দায় ভেসেওঠে কতকিছু...
আমিও তো ছিলাম ঠিক এমনি
এমনি নিষ্কলুষ শিশু

সদ্যোজাতের কান্নায় ভাসে,
ছড়িয়ে পরে আকাশে বাতাসে,
তার নতুন অস্তিত্তের বানী,
ত্রিলোক ছাড়িয়ে যায়, কিবা বলতে চায়,
ছোট্ট শিশুর নবকল্লোল

আদর ভরা চাউনি, দুপাটি চোখের পরশ,
দুহাতের কোমল মলাট,
পরিচিতের আনন্দের শব্দরস...

কি আর চায়... এতেই,
প্রান ভরে যায়,
শিশুর মুখে ভেসে ওঠে, আনন্দের জয়গান। 

"এতটুকুই মোর চাহিদা..."
কি সৌভাগ্য ! কিছুই আর সে চায়না
এই পৃথিবীর ময়দানে,
নিজেকে সুন্দর বলছে সে...
খিলখিলিয়ে হাসছে সে...
চোখে উঠেছে ভেসে তার,
অনির্বাণ জ্যোতি
মধ্যগগনে বিস্তারিত...

অনাদি, অনন্ত... দ্যুতি

Sunday, December 9, 2018

খরগোশের ডাইরি (Khargosher dairy) # the end

Rabbit, story, tail

দিন চলতে থাকে তার নিজের গতিতে। হঠাৎ একদিন চোখ যায় ঘরের এক কোনে। নেটের চেহারা পাল্টেছে। আমার চোখ রংগিন হয়ে ওঠে। 
এই রঙ আমার চেনা, অনেক বার হয়েছে, খাঁচার নেট পাল্টানোও হয়েছে। দিন কতক থাকলেই এই রঙ নেট ফুটো করে ফেলে। আর এদিক ওদিক না ভেবে, পা দিয়ে সমানে আঘাত করতে থাকি আমি সেই স্থানে। ঝন্‌ ঝ্‌ন করে ওঠে আমার ঘর। আরও, আরও, আরও কয়েকবার আঘাত করতেই নেট ছিড়ে যায়। আমার সারা শরীর শিহরিত, বুঝতে পারছিনা কি করব। কোনদিন একলা বাইরে যাইনি, বাবলু সবসময় সাথে থাকে, কোথায় যাব, কোনদিকে যাব সব ঠিক করে দেয় বাবলুই। আমার প্রতিবেশিরাও বাইরে, আশেপাশে কেউই নজরে পরছে না। সামনের নেট ফুটো হয়ে গেছে, বের হলেই বাইরেটা একাএক আমার হয়ে যাবে। যা সবসময় চেয়ে এসেছি আমি, স্বপ্ন দেখেছি স্বাধীন হব, আজ সেই রাস্তা এক্কেবারে খোলা। আমাকে থামাবার কেউই নেই। আর ভাবতে পারছি না... একলাফে আমি বেড়িয়ে আসি বাইরে। 
রোজ বিকেলে বের হই কিন্তু এ মুহুর্তে বাতাসের গন্ধ যেন অন্যরকম। মনে হয় যেন প্রকৃতির স্বাধীন সংসারটা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এগিয়ে যেতে বারবার উৎসাহ দিচ্ছে। আর সেই ডাকে আমিও এগিয়ে চলেছি ধীরে ধীরে। আবিস্কার করে চলেছি অদেখা নতুন ধরাকে। বাবলুই কোলে করে সেই যে রোজ বিকেলে একই সবুজ দেশে আমি যেতাম, সেই পথ আমি চিনিনা।  কোন দিকে সেটা আমার মনে নেই। সেই দিকে আমি যাবই বা কেন। ছুটে চলেছি এক অজানা দিশায়, অজানা রাজ্যের দিকে। কত প্রাণী, অনেকে বড়, অল্প বড় বা আমার থেকেও ছোট, কেউ আমাকে দেখছে কেউবা দেখছে না। আমি শুধুই ছুটে চলেছি অক্লান্তভাবে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বাধীনতার গন্ধে সতেজ হয়ে উঠেছে তনু মন। দিকবিদিকশুন্য আপনগতিতে ছুটে চললাম আমি রাস্তা যেখানে নিয়ে যায় আমায়। 
হয়ত অনেক দূর, কোন খোলাপ্রান্তরে, যেখানে আশেপাশে এলোমেলো মাটি, লম্বা লম্বা ঘাসের মেলা, ঝোপঝার। কোথায় এসে পরেছি জানিনা, তবে খুব ভাল লাগছে। অনেকদিন পর প্রথম বাধনহীন আমি। দৌরে ক্লান্ত কিন্তু আনন্দও অফুরন্ত। এদিক সেদিক দৌরে চলেছি আবার।এখানটা একটু অন্যরকম, অনেকেই আমায় দেখছে কিন্তু তবু মনে হল কেউ ছুটছে আমার সাথে, কেউ আছে আমার পাশে, আমার পেছনে। ঝোপঝার নড়ে ওঠে, আমি বুঝতে পারিনা হচ্ছেটা কি। একি সেই বেড়ালটা নাকি... এতদুর পিছু পিছু এসেছে। ভাবতে না ভাবতেই ঝোপ পেরিয়ে বের হবে মনে হল সেটি, আমি আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, কি করব বুঝতে পারছিনা, পালানোর রাস্তা বলার কেউই নেই, বাবলু নেই। একা এক আমাকে অপ্রস্তুত করে ঝোপ পেরিয়ে লাফ দিয়ে বেড়িয়ে এল দুটি... আমারি মত দেখতে... । আরে... এদেরকে তো অনেকবার দেখেছি, স্বপ্নে যাদের সাথে একজোট হবার কল্পনা করেছি বহুবার, আমারি তো জাতিভাই। তবে একি হল, ওরা বের হয়ে আমার দিকে শুধুই দেখল, তারপর যে যার নিজের কাজে মশগুল। আমি ছুটে গেলাম ওদের কাছে, পাত্তাই দেয় না। হয়ত ওরা বেশ শক্ত সামর্থ, তুলনায় আমি রোগা... তাই হয়ত চিনতে পারছে না। কিন্তু না, ব্যাপারটা তা নয়, পরিচয়বিহীন আমি আর ওরা জঙ্গলের অধিবাসি।বুঝলাম তখনি, যখন বারবার হেনস্থা হল আমার, একসাথে চলতে, ভাগ করে খেতে। 
দিন গড়িয়ে এল। আমি আমার স্বজাতিদের সাথেই আছি, তবে মতানৈক্য এখনও প্রবল। আমি ভেবে চলেছি কিভাবে উদ্ধার পাব, আবার মনে হল ঝোপের আড়ে কি যেন আছে। মনে হল যেন আরও সাথী এল বলে। আমার বাকি দুইয়েরও একি দশা, লম্বাকান এক্কেবারে খারা। আমাকে আশ্চর্য করে মুহুর্তে যে যার দিকে ছুটে পালাল, আমি পুরোপুরি নিশ্চল, কাঠের পুতুলের মত দেরিয়ে রইলাম। পেছন দিয়ে ডাক শুনতে পেলাম..."পালা..."। এবার মনে হল সত্যিই বিপদ, আমাকে পালাতে হবে... এক্ষুনি। বলতে না বলতেই ঝোপের মধ্যে থেকে সেই চেনা বড় ক্রুর মুখটি বেড়িয়ে এল। আমি কেঁপে উঠি, প্রকাণ্ড বুনোবেড়ালটি মুহুর্তে আমাকে লক্ষ করে ঝাপ দেয়। আমি স্বভাবতই নাচাতে পণ্ডিত হলেও তাকে এড়ানো কঠিন হল। আমার এসবে অভ্যেস নেই, শিকার হবার ভয়টা এই প্রথম কাজ করছে শরীরে। আমি ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পরছি। পা থামতে চাচ্ছিল বারবার, কিন্তু নিরুপায়... থামলেই ভয়ংকর মৃত্যু। বিড়ালটি মাঝে মধ্যেই খুব কাছে এসে পরছিল, বহুকষ্টে এড়াতে পারছি তাকে।হটাৎ চোখে পরে মাটির খাজে একটি গর্ত। আর না ভেবে কোনরকমে গিয়ে ঢুকি তার ভিতর। বিড়াল থমকে যায়, বাইরেই ডাকতে থাকে, দানবের মত আঁচড়াতে থাকে নখ দিয়ে। ভয়ানক উন্মত্ততা বেড়ালটির, নখের দাপটে মাটি সরতে থাকে, গর্তের মুখ আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। তার নিশ্বাসটাও অনুভব করতে পারছি আমি ভেতর থেকে। আমার ভেতর তোলপাড় ভয়, কি করা উচিত বুঝতে পরছি না। শুধুই মনে হচ্ছে আমার আয়ু শেষ। শেষ পর্যন্ত এই বিড়ালটার হাতেই মরতে হবে আমায়। আমি ভিতর থেকেই দেখছি, তার বিকৃত মুখটা ক্রমান্যয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। সে ক্রমাগত খাবলিয়েই যাচ্ছে মাটি। মুখ ঢোকার মতই হয়ে পরছে গর্ত। আমার পালানোর কোন রাস্তা নেই, আমি আটকে পড়েছি। সন্ত্রস্ত আমি উপায়বিহীন হয়ে জোরকদমে ভেতরের মাটিই খুঁড়তে শুরু করলাম। 
কিচুক্ষন পরেই, মনে হল কে যেন আমায় ডাকছে, আমার নাম ধরে। আমার সেই 'মিস্টু' নাম... সে তো বাবলু ছাড়া আর তো কেউ জানেনা। আমার বুঝতে সময় লাগেনি... এ বাবলুই। আমি জোরে চিৎকার করতে পারি না, তবুও চেষ্টা করলাম। বিড়ালের মুখটা ইতিমধ্যেই অনেকখানি ঢুকে পড়েছে। আমি চোখ বন্ধ করে সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আর পরক্ষনেই আরেকটা চিৎকার শুনতে পেলাম। চোখ খুলে দেখি, গর্তের মুখ দিয়ে দিগন্ত দেখা যাচ্ছে। আমি তন্ময় হয়ে চেয়েই থাকি, বিশ্বাস হয়না আমি বেঁচে আছি। ভেতর থেকেই দেখি বাবলুকে। আমি এগিয়ে যাই, মুখ বের করে এদিক ওদিক দেখি। আমাকে নিঃশেষ করতে আশা সেই বিড়ালটি কোথাও নিজেই পালিয়েছে। বাবলু আমাকে কোলে তুলে নেয়। ও হয়ত আন্তরিক টানেই এতদুর ছুটে এসেছে আমার খোজে। ফিরে যেতে যেতে দেখলাম, আমার সেই দুই সাথিকে, চেয়ে আছে আমার দিকে। পেছনেই ভরা জঙ্গল, হয়ত তারা সেখানেই থাকে, আমিও হয়ত সেখানেই থাকতাম। আমি বাবলুর দিকে তাকাই, সে আমাকে হয়ত ভালবাসে, আমিও হয়ত তাকে ভালবাসি, কিন্তু তারই তো হাজার পড়ার মাঝে আমি শুনেছিলাম, কষ্ট করে বুঝেছিলাম 'বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোরে'। আবার হয়ত কোনদিন সুজোগ পেলে আমিও আমার সেই সাথিদের সাথে টিকে থাকার লড়াইয়ে ভাগিদার হব। আমিও বুক ফুলিয়ে বনের মাঝে হারিয়ে যাব নিজেদের সাথে।।

                     ---সমাপ্ত---

খরগোশের ডাইরি (Khargosher dairy) #2

(... আমার থেকে অনেকগুন বড় হবে, নীল চোখ, কুটিল বৃহত মুখ, মনে হল অনেক্ষন ধরেই আমাকে দেখছিল। কি ঘটবে বা কি ঘটতে চলেছে, আমি টের পাবার আগেই হটাত্‌ বুনোবেড়ালটা আক্রমণ করে। ঠিক তখনই সেই লাঠিটা উরে আসে, বেড়াল ছুটে পালায়, আর আমি পাই এক নতুন জীবন।)

Story 2, second part


দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ

আমার খাঁচার দরজা বন্ধ। সন্ধ্যার  আগেই আমার প্রতিবেশীরা খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরে আসে। বাবলুদের ছাড়া আমরা সবাই সন্ধ্যের আগেই খাওয়া পর্বটা শেষ করি... আমাদের বংশগত অভ্যেস। আমার চোখের সামনেই মুরগী ছানাগুলো বড় হয়ে উঠল। সন্ধ্যার ঠিক আগেই ওরা ফিরে আসে বাড়িতে। উকি দিয়ে জানতে হয়ত চাইত  আমি ভাল আছি কিনা।
একটা বিষয় যা আমাকে রোমাঞ্চিত করেছিল তা হল ছোট্ট থেকে বাচ্চাদের হাটতে চলতে, খাওয়াদাওয়া খুঁজতে, খেতে কতকি শেখাল, তারপর যেই নাকি বড়  হল, একাএক মায়ের ভাব পাল্টে গেল।পাত্তাই দেয় না। সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকতে চাইলে, ঠুঁকরিয়ে ওদের ভাষায় কি সব বলে বের করে দেয়। এ কি রে বাবা, এমনও হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম... নিষ্ঠুর মা, নিজের সন্তানদের ভালবাসতে জানে না পরে অনুমান করি... হয়ত সন্তানদের স্বাবলম্বি করার জন্যই মায়ের এতবড় ত্যাগ, এই অভিনব পন্থা। অতিরিক্ত ভালবাসা যে সন্তানদের অপদার্থ তৈরি করতে পারে, হয়ত ভেবেছিল.... তাই কঠোর সিদ্ধান্ত।


আকাশ স্বাধীন, তার বুকে ছড়িয়ে থাকা নীলবর্নও স্বাধীন।পাখি, প্রজাপতিও স্বাধীন।এমনকি আমার প্রতিবেশীরাও স্বাধীন।শুধু আমারই এমন দশা। স্বাধীনতার হাত ধরে আমিই চলতে ব্যার্থ। মাঝে মধ্যে এমন চিন্তাও কাজ করে যখন বসে থাকি চুপচাপ, চোখ মেলে চেয়ে থাকি ঘরের বাইরে। অস্থির মনে হয় তখন জীবনটা। মন উতলা হয়ে ওঠে পালানোর জন্য।ঘরটা আমার হলেও, দরজা খোলার সাধ্য নেই আমার, সেটা বাবলুরই। সে আমাকে ভালবাসে, কিন্তু আমার মনটাকে কিছুতেই বুঝতে পারেনা। সে আমাকে বন্দি রেখেই খুশি। আমিও চুপ, কিছুটি বলি না। বন্দি থেকে নিজের নিজস্বতাই হারিয়ে ফেলেছি। তাই নিস্তেজ হয়েই বসে থাকি বাবলুর অপেক্ষায়। সে তো জানেনা, একটা ঘরে সারাদিন আটকে থাকা কতটা অস্বস্থিকর। বন্দিদের পীড়া বুঝবার ক্ষমতা তার তো নেই। বুঝলে হয়ত ছেড়ে দিয়ে আসত কোন জংগলে, যেটা হত আমার সঠিক বাসস্থান।চারিদিকে সবুজ, সবুজ আর সবুজ।অনেক বন্ধু পেতাম, হাসি কান্না একসাথেই হত, টিকে থাকার লড়াইয়ে সমান ভাগিদার হতাম। সে ভাগ্য কি হবে আমার!

দিন চলতে থাকে তার নিজের গতিতে। হঠাৎ একদিন চোখ যায় ঘরের এক কোনে। নেটের চেহারা পাল্টেছে। আমার চোখ রংগিন হয়ে ওঠে।  

                                      শেষ এখনও বাকি...

Monday, November 26, 2018

খরগোশের ডাইরি (Khargosher dairy)


প্রথম নামে'ই একটু আপত্তি থাকাটা ভাল। পরে... যুক্তি দিয়ে বোঝালে, মেনে নওয়া যায় বৈকি। যেমনটা পণ্ডিতমশাই... মানে 'স্যার' আর কি, বাবলুকে কথায় কথায় বলেছিলেন... নাস্তিকেরই চরম আস্তিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই ছোট্ট, গুবলা গাবলা মত দশ বছরের বাবলু'রই একটা পোষা খরগোশ আছে, তাকে নিয়েই গল্প। ও! আচ্ছা! গল্পই বা বলি কোন সাহসে, রিতিমত একটা আত্মজীবনি বলতে গেলে। তা...শোনা যাক কি বলে সেই বাবলুর খরগোশ...

######################################

Rabbit, story, kid


আমি বাবলুর মত লেখা-লিখি করি না... ওসব ভাষা আমার জানা নেই। আমি অভিজ্ঞতা নামের কলম দিয়ে মন নামের খাতায় আমার কথা লিখি। জন্মলগ্ন, জন্মস্থান...এসব আজে বাজে আমার জানা অনাবস্যক। জন্মেছি যখন, চলতেই হবে... আর বেশি বোঝার দরকারই নেই। আসলে বলি কি, বর্তমান নিয়ে চলাই আমার বা আমাদের বিশেষ স্বভাব। যা মনে রাখলে জীবন চালানো মুশকিল অথবা যা মনে রাখাই মূল্যহীন, তার আসে পাশে মনকে ঘুরানো আমাদের স্বভাব বিরুদ্ধ। তবে যা জানি তা হল, আমি 'খাঁচা' নামক এক বাসস্থানের বাসিন্দা। বেশ বড় সর, ওয়্যালটা নেটের, ছোট্ট একটা দরজাও আছে। বাবলু ছাড়া এই দরজা খোলার পদ্ধতি কাউই জানেনা। সেটা খুলে গেলেই বুঝতে পারি ঘর থেকেও বাইরেটা কত্ত বিশাল, তবে এটাই বুঝিনা... ঘর চাই কেন! আমার থেকে অল্প একটু দূরে... সরি, খাঁচায় আরেকটি পরিবার থাকে। ওদের ভাষাটা আবার বেশ শক্ত, বোঝা মুশকিল। কিই বা খাওয়া ওদের যে মাঝে মধ্যেই প্রচণ্ড দুর্গন্ধে ছেয়ে যায় আশপাশ, আমার শ্বাস ওষ্ঠাগত... দম বন্ধ করে থাকতে হয় অনেক্ষন। বাবলু বলে আমার প্রতিবেশিরা হল মুরগী, ওরা অমনি।

বাবলু আমাকে খুব ভালবাসে, মিস্টু বলে ডাকে। নামটা আমারও ভারি পছন্দ। ভালবাসা ঠাণ্ডার দিনে আরও বাড়ে যখন সে আমায় খাঁচার থেকে বের করে নিজের কোলের উপর শুইয়ে দেয় আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়াশুনা করে। ও এটাকে 'পড়া' বলে...! প্রথম প্রথম আঁতকে উঠতাম, কানে ঢং ঢং শব্দ হত। ভাবতাম... ছে রে দে রে বাবা... কেঁদে বাঁচি। বাঁচিনি... এখন অভ্যেস, পড়া শুনতে শুনতে একসময় হয়ত ঘুমিয়েই পরি। সে তার নিজের ঠাণ্ডা হাত দুটো আমার লোমশ শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে রাখে। শুনেছি... ওরা মানুষ, তাদের কথা আমায় আন্দাজ করে বুঝতে হয়। তবে বাবলু যে কি পড়ে, সেটা বোঝা দুষ্কর।

আমার প্রতিবেশীদের ঘরটা বেশ মজার, বেশ জমজমাট। আমার থেকে যদিও একটু নোংরা বেশি, তথাপি ভাল। কয়েকদিন হল কতগুলো নতুন অতিথি এসেছে, বড্ড চেঁচামিচি করে। তবে আমার খারাপ লাগেনা। ছানাগুলো বেশ আদুরে। মা ওদের খুব ভালবাসে। একটু এদিক অদিক হলেই, ব্যাতিব্যাস্ত হয়, তন্ন তন্ন করে খোঁজে। না পাওয়া পর্যন্ত চিৎকার- হাহাকার অবস্থা। কিন্তু দেখে আশ্চর্য হই যে তারপর ঘটনার কোন ছাপই থাকেনা তাদের চোখে মুখে। মুহূর্তে সব ভুলে গেল, যেমন চলছিল তেমনই চলছে। অতিরিক্ত চিন্তা না করাটাই মনেহয় তাদের স্বভাব। আমার ছোটবেলের কথা মনে নেই, আমার মা আমায় ভালবাসত কিনা জানিনা। তবে এখন যাদের কাছে আছি তারা যে আমায় ভালবাসে, সেটা নিশ্চিত। বন্ধ খাঁচার ভেতর দিয়ে যখন দেখি, রোজ সকালে প্রতিবেশীদের ছাড়া হয়, আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডাকতে ডাকতে বেড়িয়ে যায়, বেশ ভালও লাগে। যাওয়ার সময় আমার ঘরটিতেও উকি দিয়ে যায়। কথাতো বুঝিনা, তবে টা-টা বায়-বায়... এমনি হয়ত কিছু বলে। ঘরে থেকে যাই আমি একলা। হাত দুটো সামনে ভাজ করে, মুখ সামান্য নুইয়ে, লম্বা কান দুটো আলসে ভাবে গায়ে ফেলে রেখে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকি বেড়িয়ে যাওয়া দরজার দিকে। ভাবি... আমিও যদি... । তবে একেবারে যে বেড়ই না, তা নয়। রোজ বিকেলে বাবলুর সাথে বাইরে যাই। তার সাথেই ছোটাছুটি করি। সে আমাকে নিয়ে যায় সবুজের দেশে, যেখানে অনেক ঘাস, দূর্বা'র বন,  অনেক পাতা, আসেপাশে ফুল। সারা শরীরে তখন আমার আনন্দের নদী বইতে থাকে। আমি উত্সৃং‌খল হই, এদিক অদিক দৌড়াদৌড়ি, আমার আবোল তাবোল অঙ্গিমা ভঙ্গিমা দেখে বাবলুও হাসতে থাকে। বিকেলের এই সময়টা আমার কাছে ইহজগতের বরদান।

আমাকে নিয়ে বেড়লেই, বড় লম্বা লাঠি থাকে বাবলুর হাতে। কেন যে নেয় সে এটা প্রথমে বুঝিনি, বুঝলাম একটা ভয়াবহ ঘটনার পর। বলতে গেলে, সেই লাঠিটির জন্যই আজ আমি আছি। আমি সবুজ মাঠে পেট পূজোতে ব্যাস্ত। সবকিছুই ছিল সুন্দর। ঝড়ের মত একটা ঘটনা ঘটে গেল হটাত্‌। প্রচণ্ড গতিতে চোখের নিমিশে প্রকান্ড সেটি ছুটে এসেছিল আমার দিকে। বাবলু, সেই বাচিয়ে ছিল আমায়, হাতের লাঠিটি ছুরে দিয়েছিল সজোরে, আঘাত করল আতিদানবটির দিকে। আমার মাত্র এক হাত দূরে, ভয়ে সিটিয়ে গেছিলাম এই হটাত হওয়া ঘটনায়। সন্ধ্যের আগেই ঘরে ফিরে এলাম সেদিন। ঘরে চুপ করে বসে মনে করতেই চোখের পরদায় ভেসে ওঠে ঘটনার এক একটা ক্রম। আমার শারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। শ্বাস প্রশ্বাসে টান পরে, শিতল হয়ে যায় সারা শরীর। ... আমার থেকে অনেকগুন বড় হবে, নীল চোখ, কুটিল বৃহত মুখ, মনে হল অনেক্ষন ধরেই আমাকে দেখছিল। কি ঘটবে বা কি ঘটতে চলেছে, আমি টের পাবার আগেই হটাত্‌ বুনোবেড়ালটা আক্রমণ করে। ঠিক তখনই সেই লাঠিটা উরে আসে, বেড়াল ছুটে পালায়, আর আমি পাই এক নতুন জীবন।
                                                    
                                                   শেষ এখনও বাকি...



Monday, November 19, 2018

দহন (Dahan) #3 the end

 কুটিল মনস্তাত্ত্বিক ক্রমবিকাশ শুরু হয়েছে তার ভেতর। আকাশে আবার মেঘ গর্জে উঠল..
.....................................................................................................

Story, mystery,  killing


রটি এখন শান্ত, সোফার এক কোনে বসে ব্যাগে টাকাগুলি গুটিয়ে রাখছিল মিহির। সে রাঘবকে দেখতে পায়নি। মিহিরকে একবার দেখে মন্থর গতিতে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় রাঘব। সবজি কাটে, চাল ধোয়, স্টোভ ধরায়, খাবার বানায়, দুজনের জন্যই থালায় বাড়ে খাবার। সকাল থেকে আজ কেউই কিছুটি খায়নি, পেটের ক্ষিদেরো কোন  খবর নেই। এদিকে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি, দিনটা আস্তে আস্তে আরও কালো হয়ে আসছে। এযেন অস্থির অবস্থা, ঘরের বাইরে, মনের ভিতর সর্বত্রই। মিহিরকে দেখল সে, সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, হাত দুটি তার কপালের ওপর, মুষ্টিবদ্ধ। ব্যাগটি তার পায়ের কাছে সোফার উপর। রাঘবের হাত কাঁপছে, রাঘবের মন দূর্নিবার পরিকল্পনা করে চলেছে। ঐশ্বর্যশালী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় দেওয়ার পরিকল্পনা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সে পাশের ড্রয়ার থেকে এক ফাইল ওষুধ বের করে। এগিয়ে যায় মিহিরের জন্য বেড়ে রাখা খাবারের থালার দিকে। সুগন্ধি খাদ্যে মিশিয়ে দেয় চিরনিদ্রার ওষুধ।
একই ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি তার। তাই সয়ে যাওয়া সেই শব্দ ঘরের ভিতরের সাময়িক স্তব্ধতাকে বিরক্ত করছেনা আর। মিহিরকে ডাক দিল সে।
“কিরে তৈরি হয়ে গেল, এত তারাতারি”
“এই আর কি...বেসি কিছু খাওয়াতে পারলাম না” রাঘব অনেক শান্ত, চোখ তার হাতের থালার দিকে।এগিয়ে এসে রাখল টেবিলে, একটি থালা এগিয়ে দিল মিহিরের দিকে।
“চলবে চলবে... সকাল থেকে কিছুই হয়নি, এ তো অনেক...”
থালার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে মিহির উঠে বসল সোফা থেকে। সামনা সামনি বসে একে অপরের। “ বাহ্‌ বেশ রান্না করিস তো তুই... গন্ধ দারুন বেরুচ্ছে...” রাঘব কিছুই বলছেনা দেখে মিহিরই আবার বলল “ কিরে তোর কথা কমে গেল হটাত... খারাপ পেলি!”
মিহিরের কথায় চমকে ওঠে সে, টেনশনে গা তার গুলোচ্ছে, কথা কি বলবে। সামান্য হাসল রাঘব “চল শুরু করা যাক”
সামনে থালা, থালায় খাবার, দুটোতেই একই জিনিস। তবে একটি জীবন সহায়ক অন্যটি নাশক। মিহির ক্ষুদার্ত, সে শুরু করে দিল। রাঘবের পেটেও আগুন জ্বলছে, উন্মত্ততার। তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। কেউই কোন কথা বলছে না। সে দেখছে মিহিরকে, সেই যা মাঝে মধ্যে রান্নার কথা বলছে, বলছে শহর ছাড়ার কথা, তার সাহসিপনার কথা। রাঘব দেখছে তাকে শুধু... অপেক্ষা করছে ওষুধের কাজ করার। সে খেয়াল করছে মিহিরের কথা আস্তে আস্তে কমে আসছে, পেঁচিয়ে যাচ্ছে তার কথার সুর, কথার ছন্দ। মিহিরের চোখ জুরিয়ে আসছিল, সে খাওয়া ছেরে রাঘবের দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। মিহিরের মাথা ঘুরছে, চোখদুটো কেমন জানি ফেকাশে হয়ে যাচ্ছে...হ্যা হ্যা রাঘব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। রাঘব দেখতে পাচ্ছে অপূর্ব সুন্দর লেদারের কালো ব্যাগটাকেও যার মধ্যেই আছে তার সব স্বপ্ন পুরনের টাকা... হ্যা টাকা..টাকা, অনে...ক টাকা।
মুখ থুবড়ে পরল মিহির হালার উপর। দাড়িয়ে পরে রাঘব, তার শরীরে কুকুরের লোভ আর শিয়ালের ধূর্ততা একসঙ্গে কাজ করছে। সে মুহূর্তে ছুটে যায় ব্যাগটার দিকে। চেন্‌ খুলে হাত বুলোয় সেই টাকাগুলোর ওপর, অজান্তেই একফোঁটা লালা গড়িয়ে পরে তার মুখ থেকে সেই পাতলা কাগজের নোটের ওপর। তার দৃষ্টি অশান্ত, ব্যাগের অন্যান্য চেন্‌’গুলোও তারাতারি খুলতে থাকে সে।কিছু খুজছে সে কিন্তু পাচ্ছে না, তীক্ষ্ণ নজরে রাঘব খুব ব্যাস্ত। “পাচ্ছি না, পাচ্ছি না...কোথায় লুকোলো সেটা...হ্যা হ্যা... জ্যাকেট...পকেটে...” পাশেই রাখা লেদার জ্যাকেটের পকেট তন্য তন্য করে খুজতে থাকল সে। কিন্তু হটাত...
রাঘবের পেছনেই টেবিলে মুখ থুবড়ে পরে থাকা মিহিরের চোখ খুলে গেল। ঝাপসা...ঘরের পরিবেশ, মাদকের মত দুলছে তার হাত, তার শরীর। রাঘবকে দেখতে পেয়েছে সে পেছন থেকে। তার জামার ভেতর থেকে বেড়িয়ে এল খাঁজকাটা সেই ছুরি’টা। রাঘব পায়নি, সে মিহির কেও দেখতে পায়নি। মিহির এগিয়ে এল ধীর পায়ে, হাতে তার নৃসংশ অস্ত্রটি। জাপটে ধরল রাঘবকে পেছন থেকে, ছুরিটা ঠিক তার গলার টুটিতে।
“কি! মূর্খ ভেবেছিলি আমায়? হ্যা... ধোকা দিবি... টাকা..লাগেনা... খুন করবি আমায়... বোকা পেয়েছিস...সব বুঝি আমি”
রাঘব হতভম্ব, সে কেঁপে উঠেছে, আঁতকে উঠেছে, মাথা নড়াতে পর্যন্ত পারছেনা। তার ছোখ লাল, হাতে নাতে ধরা পড়েছে। মিহির মরেনি, অজ্ঞান হয়ে পরে ছিল। মৃত্যুমিস্রিত খাবার সে বেসি খায়নি, তার চেয়ে ক্ষিদের তারনায় জল খেয়ে খয়েই পেট ভরেছিল। বলতে গেলে জলই তাকে মরতে দেয়নি।
তবে মিহিরের শরীর গুলচ্ছে, সামান্য হলেও তো বিষ কাজ করেছে। তার হাত কাঁপছে, সাথে ছুরিটাও
“মিহির তুই...” রাঘবের গলা কেঁপে উঠেছে, কান্না পাচ্ছে তার।
“না...মরিনি... ধোকেবাজ”
“ছেরেদে..ছেরেদে... প্লিস”
“তোকে?...আমাকে মারবি!দেখ মরিনি...ভেবেছিলি একাই সব হাপিস করবি...তুই...হ্যা এখন তুই মরবি, হ্যা তুই যাবি উপরে...অনেক উপরে...পৃথিবীর ব্যালকনিতে... আর আমি হব... নতুন ‘রাঘব’...।”
শান্তি, একদম শান্তি। বৃষ্টি থামেনি, গর্জনোৎপাতও কমেনি। মিহির সোফার গদি দিয়ে চেপে ধরেছে রাঘবের শিরাকাটা গলা, রাঘব ছটফট করছে। গারো সবুজ গদিটা এক সময়ে কালচে লাল হয়ে গেল আর ফ্যাকাসে হয়ে গেল রাঘবের মুখ।
বলা হয় ধূর্তের ছলের অভাব হয় না, রাঘব নামে নিজেকে বদলে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে মিহির উরে যায় অন্য কথাও। শহরের বাইরে পাওয়া যায় একটি মৃতদেহ, ব্লু জিন্স, লেদার জ্যাকেট আর কালো লেদার ব্যাগ, শূন্যতায় পরিপূর্ণ। টুটি কাটা, মুখ বিকৃত... চেনার উপায় নেই। পুলিশ শনাক্ত করে বলে, তিন চোরের এক চোর, বাকি দুই তাকে মেরে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে, নিয়ে গেছে সব টাকাও।
......................................................................

এই হল সব কথা, সব ঘটনা, একদম সব। প্রথমে যে ঘরবন্দি রাঘবকে জেনেছিলাম, আসলে সে তা নয়, সে মিহির। লক্ষ টাকা চুরি করাদের একজন। আজ তার যত সম্পত্তি সবই সেই চুরি করা টাকা থেকে হয়েছে এককালের বন্ধুকে মেরে নিজে বেঁচে পালানোর জন্য। কিন্তু সেই দিনটার পর শান্তিও তার জীবন থেকে পালিয়ে গেছে। মানসিক ঘাতপরিঘাতে তাকে অশান্ত হতে হয়েছে দিন পরদিন। মনে হত, কেউ আছে যে সবসময় তার দিকে চেয়ে রয়েছে, কাজে ব্যাঘাত করছে, তাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হয়রান করছে। একাকীত্বে সেই আতঙ্ক আরও বেড়ে যেত। বাঁচতে সে বিয়েও করে, কিন্তু ভয় সবসময় স্ত্রী যদি সব জেনে ফেলে, পুলিশ যদি টের পায়। তার রূঢ় আশ্চর্য ব্যাবহার ঘরময় এক ক্লেশকর পরিবেশ তৈরি করেছিল। সংসার ভেংগে গেল।
আজ সে আক্রান্ত, সে বুঝতে পারে তার মনের বিভাজন ঘটেছে, এক মন্দ আরেক ভাল। আর এই ভালোর দিকটার শক্তি হটাতই খুব বেড়ে গেছে। সে মন্দকে হারাতে চাইছে। মানসিক বিরক্তিতে ছটফট করছে, অধৈর্য করে তুলেছে। সে বুঝতে পারে, পাগল হয়ে যাচ্ছে সে দিনদিন। সম্পূর্ণ জগত, জীবন যেন শুন্য।
অনেকদিন পর, ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে সে... যার নাম মিহির। স্থির চোখে এগিয়ে যায়...থানার দিকে। এরকম শেষই হয়ত তার প্রাপ্য, তার যোগ্যতম শাস্তি।।
   ‌‌‌‌‌                                                           ------সমাপ্ত------

Sunday, November 18, 2018

দহন (Dahan) # 2

রাঘব হতবাক হয়ে গেছে মিহিরের কথায়।তার চোখে হাজার প্রশ্ন।

Story, bengali thriller


“নেই বলবি বুঝলি...আধা পাবি তুই...আধা...বুঝলি...”
রাঘব নির্বাক, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এদিকে অনবরত কলিংবেল বেজেই চলেছে। রাঘব মিহিরকে পাশে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল, দরজা খুলতেই সামনে সত্যিই পুলিশ। রাঘব সোজা হয়ে দাঁড়াল। দারোগা গর্জে ওঠে... “কি হল, এত সময় লাগে”
“না...মানে...ঘুমিয়ে...ঠান্ডা তো...” রাঘব সামলে নিল নিজেকে। তার আপাদমস্তক ভালকরে দেখে দারোগা হুঁশিয়ারি দিয়ে গেল “ রাস্তায় মানুষজন খুব কম, কুয়াশাও বেশ, আমরা আছি তথাপি বলে যাচ্ছি, ব্যাঙ্ক থেকে নব্বই লাখ...অনেক টাকা ডাকাতি হয়েছে, প্লান্‌ড গ্যং এর কাজ, শহর ঘেরাও এখন, পালাতে পারেনি, হাপিস হয়েছে কথাও। বড় কালো ব্যাগ, একজনের নীল জিনস অন্যদের কালো, ব্ল্যাক লেদার জেকেট পরা। এদিকেই আসা দেখা গেছে। চুরি গেছে লকারে থাকা একটা ঐতিহাসিক চাকু’ও। সাবধানে থাকবেন, হদিস পেলে বা দেখলে তৎক্ষণাৎ খবর দেবেন, ঠিক আছে...”
“...ঠিক আছে...” মন্ত্রমুগ্ধের মতন বলল রাঘব।
“আপাতত তো কিছু দেখেন নি...তাই না?”
“ন...না” এক নিষ্কুল ঘোরের মধ্যে রাঘব।
“ওকে, টেক কেয়ার”
পুলিশ চলে যেতেই পাশ দিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিল মিহির। তারপর বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে তার চোখে চোখ রেখে বলল “হু...তুই যা বুঝেছিস ঠিক তাই।আমিও একজন...”
বন্ধ দরজার ওপর ছিটকে পরল রাঘব, মাথায় হাত দিয়ে বসে পরল দরজা ঘেষে নিচে। থরথর করে কাঁপছে সে...ঠান্ডায় নয়, ভয়ে। 
“কি হবে এখন, তুই...পারলি কিকরে... আমি...আমি জেলে যেতে পারব না...তুই এখানে জানতে পারলে পুলিশ আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে...” বিরবির করে বলে যাচ্ছে রাঘব। 
মিহির কিছুই বলছেনা, সে সোজা গিয়ে সোফার নীচে লুকিয়ে রাখা ব্যাগটা নিয়ে এল।ব্যাগের চেইন একটানে খুলে ফেলল সে। রাঘব চমকে সেদিকে দেখে...উন্মুক্ত করকরা টাকার মেলা। স্বপ্ন রঙ্গিন করা রঙবেরঙের আতশবাজির খেলা। কক্ষনও দেখেনি সে একসাথে এত টাকা। মিহির সেখান থেকে কয়েক বান্ডিল বের করে তার সামনে ছুরে দিল। একাএক ছড়িয়ে পরল নোটের বান্ডিল আসে পাশে। রাঘবের সারা শরীর কাঁপছে, ভয়ে না উত্তেজনায়, সে ফ্যালফ্যাল চোখে মিহিরের দিকে তাকায় 
“তুই ডা...ডাকাত, এ...এতটাকা... নব্বই লক্ষ...” রাঘবের চোখ রক্তশুন্য
“না, তিন ভাগের এক ভাগ আমার কাছে”
“এ...এতোটাকা...চুরি করেছিস...”
এতক্ষণে পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে গেছে ঘরের। মিহির সামান্য উত্তেজনার সাথেই বলে চলল সব কথা... “বললাম তো মাত্র একভাগ আমার কাছে, বাকিরা উরে গেছে যে যার ভাগ নিয়ে। আমি আর পারছিলাম না, পারছিলাম না রাস্তার ভিখিরির মত বেঁচে থাকতে। বরদাস্ত করতে পারছিনা এই শোষক সমাজের নির্লিপ্ততা, তাচ্ছিল্লতা। এক শ্রেণী আমাদের পদদলিত করে ফুলে ফেপে উঠবে, কর্ণধারেরা সামাজিক বৈষম্যতা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে যাবে, আর আমি কি না খেতে পেয়ে পচে মরব, সেটি হবে না চাঁদু...”
“তা...আমিও তো চলছি...এ ভয়ানক বাজারে”
“তোরও দিন আসবে, যখন এই বাজারই তোর নাগালের বাইরে চলে যাবে। তোকে বাঁচার কোন আধিকার দেবেনা আর এক শ্রেণীকে দেখবি তোর ভাগেরটা কিভাবে নষ্ট করছে। তখন জলবে গা... বেশ করেছি যা করেছি। তোদের সমাজেরই তো এ টাকা। যাদের কাছে ঘুরে ঘুরে পা ব্যাথা, মুখ ব্যাথা হয়ে গেল, এ তাদেরই টাকা”
কিংকর্তব্যবিমূর রাঘবের দিকে তাকিয়ে মিহির বলে “ ঘুষ দেবার টাকা ছিল না তখন, আমার সাথে ভিখিরির মত ব্যাবহার করেছে ঘুষের টাকায় রাজত্ব করা ওই মালিকেরা, দেখ দেখ, এখন আমার কাছে কত্ত টাকা”
“কিন্তু তাই বলে তুই চুরি করবি...ডাকাতি করবি!”
“হা হা...জানিস না... যেটা তোর, যা চেয়ে পাওয়া যায়না, তা ছিনিয়ে নিতে হয়”
“উপার্জনের জন্য তো তোকে কষ্ট করতেই হবে ভাই...”
“বইয়ের ভাসা...হু...থাক্‌ থাকগে... সবাই বড় হচ্ছে, ছলে বলে কৌশলে, আমি একলাফে গাছে উঠতে চেয়েছিলাম, দেখ উঠে আমি ফলও পেরে নিয়ে এসেছি” টাকার ব্যাগটা একাএক রাঘবের চোখের সামনে তুলে ধরল মিহির। 
মিহিরের চোখের রং, কথার ঢং যেন পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রাঘব যেন কেমন নেশাগ্রস্ত হয়ে পরছে। উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে মিহিরের কথাকে খন্ডাতে পারছেনা। মিহির আরও কিসব বলে যাচ্ছিল কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
কান দুটো যেন বন্ধ হয়ে গেল তার, দিকবিদিক শুন্য হয়ে এদিক অদিক দেখছে সে। বুঝেতে পারছে না কোন দিকটা ঠিক। চোখে পরল মিহিরের প্রচন্ডভাবে নরতে থাকা ঠোঁট দুটো... যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল অনেক দূর থেকে...
“তবে তুই আমায় বাঁচিয়েছিস, তুই আমায় নতুন জীবন দিয়েছিস, তোকে কথা দিয়েছিলাম দেব...এই তোর ফিফ্‌টি পারসেন্ট”
ব্যাগের থেকে থাক থাক নতুন নোটের বান্ডল বের করে রাখল সাদামাটা সোফাটির ওপর। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হচ্ছে পুরনো ম্যাটম্যাটে সোফায় নতুন নোটের বাহার। বিনাখাটুনীতে অতগুলো টাকা... রাঘব আঁতকে ওঠে। 
“না না লাগবে না... এ...এটাকা আমি ধরতেও চাইনা। দেখ, তুই আমার বন্ধু...তাই...কিন্তু...না না...উহু...”
একেবারে পিছনে ছিটকে যায় রাঘব।
“নেনে...ফিরিয়ে নে...এটাকা আমি ধরতেও চাই না”
অতিভদ্রতা দেখিয়ে কোন লাভ নেই ভাই...জগতের অভদ্রতার শিকার হবি মাত্র
মিহিরের ভয়ানক শব্দগুলি এক এককরে বিদ্ধ করছিল রাঘবকে। সে নিজেকে ঠিক রাখতে কিছুতেই পারছিল না। তথাপি...
“না না, এটাকা হজম করার ক্ষমতা আমার নেই, তুই বস...বস আমি আসছি...”
মিহিরের টাকা ধরে থাকা হাতটাকে ঠেলে সরিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল রাঘব।
................................................................................................
 সাতসক্কালে বিছানায় শুয়ে কত ভালোলাগা স্বপ্নে মসগুল ছিল সে, দিনটা যেমন মনটাও তেমনি আলসে হয়ে ছিল। দিনটা এভাবেই পার করবে বলে ভেবেছিল। তারপর কি যে হল, মিহির বাইরের ঝড় বয়ে নিয়ে এল ঘরের ভিতর। ধংস হল সুন্দর সাবলীল সকালটা। বাথরুমের বাসিনে ভর দিয়ে দারিয়ে সামনের আয়নাতে নিজেকে দেখছিল রাঘব। কল খুলতেই বেসিনের উপর জল আছড়ে পরল।রাঘব হাত ধোয়, মুখে বার বার জল ছিটোয়, চুলে মাথায় ঘারে জল দিয়ে একটু সামান্য হতে চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করে বেশ কয়েকবার জলের ঝাপ্টা দেয়, দুহাতের পাতা দিয়ে মুখমণ্ডলের জল সরায়...কিন্তু একি... শরীর মন মাথা তো শান্ত হচ্ছে না, হাতটা কাঁপছে, চোখের বলয় কাঁপছে, হাত যেন সরতে চাইছে না মুখ থেকে, চোখের উপর থেকে। মস্তিষ্কের অন্তগহ্বরে যেন হটাত ফেটে উঠল বোমা... খোলা ব্যাগের টাকাগুলো একাএক ভেসে উঠল চোখের সামনে। বেসিনের সামনের ছোট আয়নায় সে যাকে দেখল তা সে নয়, এ তো আচেনা কেউ... তার চোখ লাল, অপার্থিব নেশা, মুখে আকণ্ঠ লোভ, রাঘবের শরীর শিরশির করে ওঠে। মনে হল মাথাটাকে কেউ জাপটে ধরে রেখেছে। জবরদস্তি কব্জা করতে চাইছে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ চক্র। একে একে আসতে থাকে হাজার চিন্তা, অনেক পরিকল্পনা। বারবার চোখে ভেসে ওঠে একপলক দেখা সেই অসামান্য ঐতিহাসিক ছুরি’টি। রাঘব বেসিন ধরে দাড়িয়ে, তার বড়লোক হবার নেশাটা আবার চাড়া দিয়ে উঠেছে। মিহিরের কথাগুলো বারবার ধ্বনিত হচ্ছে তার কানে। সে সেই ভাবেই দাড়িয়ে... তার চোখমুখে সৃষ্টি হল এক পৈচাশিক হাসি। মুখ নিচু করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। কুটিল মনস্তাত্ত্বিক ক্রমবিকাশ শুরু হয়েছে তার ভেতর।  আকাশে আবার মেঘ গর্জে উঠল...
                                                                                                                                     চলবে....

Saturday, November 17, 2018

দহন (Dahan)


Story, murder, suspense


ঘরে লক্ষ্মী, নারায়ণ, সরস্বতী কেউই নেই, মানুষটা পাষণ্ড। মূল্যবান টাকার চারকোনা রূপটাই তাকে পাষণ্ড বানিয়েছে। এই অতিমাত্রিক নেশাই তাকে দূর করে দিয়েছে তার সংসার থেকে। মনকে মর্মান্তিক করে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে অজান্তিক স্বপ্নের এলাকায়।

এক দুরূহ প্রাচীরময় বদ্ধ ঘর, আবদ্ধ তার প্রান সারাক্ষণ ছটফট করছে খোলা আকাশ দেখবে বলে, কিন্তু পারছে না কারনবসত কোন ভয়ে। নাম-রাঘব, অবস্থান-বর্তমানে এক জীর্ণ ইটপাথরের তৈরি বাড়ি। যান্ত্রিক জীবনের সুকঠোর স্পর্শে সে আজ এক অজ্ঞাত অধ্যায়ের সুপরিচিত রূপ মাত্র।

লোড, লোড, লোডশেডিঙে মানবজীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছে। সেদিনও হঠাৎ অন্ধকার, এমনকি নিজের হাতটাও খোঁজা বৃথা।অন্ধকারের দূর্গমতা ও প্রাচুর্যের অভাব বাইরেও।...ঘরের ভেতরে খচমচ শব্দ-কাগজপত্রের, টুংটাং শব্দ ঝনঝনে রূপান্তরিত হয়ে ভেঙ্গে পরল টেবিলে হাত লেগে। খুজে খুজে একটি দেশলাই পেল রাঘব...ছস্‌স্‌স্‌স্‌। অন্ধকারময় ঘরটিতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ একটি দেখা যায়।আলোকদ্ভাসিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যেই আবার ডুবে যায় অসীম অন্ধকার রাজ্যে। ...কাঠি গুলো সব বাজে...রাঘব কর্কশ ভাবে চেঁচিয়ে ওঠে। একাংশে বারুদাবৃত দিয়াশলাই কাঠি নামের স্ফুলিঙ্গ বর্ষণকারীর আবার ঘর্ষণের শব্দ হয়...না এটাও বাজে। এককোণে একটি বিড়াল বসে, রাঘবের বিলম্বিতায় সেটি বকা দিয়ে ওঠে। রাঘবও অশ্রাব্য কিছু খেঁকিয়ে ওঠে। ছস্‌স্‌স্‌স্‌... অন্ধকার চিরে আগুনটাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ল্যাম্পের দিকে। জ্বলে ওঠে সেটি, রাঘব চমকে ওঠে হটাত। এ ঘরে মানুষ বলতে সে একা, তার পেছনেই এক বিশাল ছায়ামূর্তি মাত্র। বোধশক্তিহীন বিড়ালটি ডাকতে ডাকতে সেই বিক্ষিপ্ত ছায়ার দিকে এগিয়ে যায়। অস্ফুট চিৎকারে রাঘব ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় আলো।

ঘটনাটি নতুন নয়, কিন্তু রাঘব অভ্যস্ত হতে পারেনি এখনও। এ যেন তার থেমে যাওয়া জীবনের বিকৃত অতীতের হাত যা পিছু করে বেড়ায় সর্বক্ষণ তাকে। যার ফল-পাগলামি, মেন্টাল ডিসঅরডার। চোখ দুটি দিনকেদিন স্ফিত হয়ে যাচ্ছে, আর হবেই না কেন, রাতে ভালো ঘুম হয়না, চোখ বুজলেই দেখতে পায় তার অতীতকে, সেই সব নৃশংস ঘটনাগুলোকে, যা তাকে তারনা করে বেড়ায় সবসময়। অবস্থা বেহাল দেখে, সম্পর্কছিন্ন কিছু বন্ধুরাই তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেছিল মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। সব শুনে তিনি বললেন-
“ব্যাপারটা আজকের জীবনের, এ যুগের যান্ত্রিক জীবনের প্রতিফলন মাত্র। জাস্ট রিফ্লেকশন...আর কিছু নয়।
কিন্তু সবটা শুনলেও, সব শোনা হয়ত হয়নি আসলে। কেননা সব, একদম সব বলা হলে তবে তো! তাছাড়া ডাক্তারের কথার উল্টোটাও তো হতে পারে। যেমন, রাঘবের কোন কাজের প্রতিফলন ঘটেছে তার আজকের জীবনে...জাস্ট অপোসিট রিফ্লেকশন।

............................................................................................................

এমনিতেই শীতকাল, তার উপর আকাশে কালো মেঘের সমাগম ঘটেছে ধীরে ধীরে। দূরে যে কোথাও ব্জ্র-বিদ্যুতের মাতলামি চলছে তা নিশ্চিত। সময়টা মধ্য ডিসেম্বর, সালটা আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে হবে। খুব স্যাতস্যাতে ঠান্ডা, সকাল থেকেই কুয়াশা, দিনটা একদম বাজে। মধ্যবয়সী রাঘব শুয়ে, শীতকালটা পারলে সে ঘুমিয়েই কাটায়, তার উপর আজ রোববার। খামখেয়ালিপনায় নির্লিপ্ত চাকরীর দোকানটিও বন্ধ, যার কর্মচারী বলতে মালিক ছাড়া সে একা। এই ব্যাচেলার মানুষটির ঘরটি অগোছালোই থাকে। কিন্তু, এক লাফে গাছে উঠে বড়লোক হবার কীট কিলবিল করে সর্বক্ষণই তার মাথায়। তবে আপাততের জীবন তাকে ছাড়তেই ছায় না, গাছে ওঠা আর হচ্ছে না, বারবার পিছল খাচ্ছে।  তবে ব্যাথা ভুলতে সিনেমার হিরোদের মতন সে নেশা করেনা, জুয়া খেলে না। মাতাল হয়ে যে স্বপ্ন দেখা বৃথা তা সে জানে। লেপ জরিয়ে শুয়ে শুয়ে এসব মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল কি এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল। বিরক্তিময় মুখটা নিয়ে উঠে এসে দরজা খোলে সে। পরনে ব্লু জীন্স, পায়ে কালো বুট্‌, লেদার জ্যাকেট, হাতে কালো গ্লোভস, কালো লেদার ব্যাগ, চোখে কালো চশমা আর মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে একজন দাড়িয়ে সামনে।রাঘব ঢং ঢং করতে থাকা ওয়াল ঘড়িটার দিকে দেখে, মাত্র নটা। সামনে তার পুরোনো বন্ধু।
“মিহির...তুই! এত্ত সকালে!বিরক্ত করার আর সময় পাস না...”
“তুই আর...আলসি...” এই বলেই মিহির তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে্র ঢুকে পরল।
“কি দেখছিস, নে নে দরজাটা বন্ধ কর, খুব ঠাণ্ডা লাগছে...”
“কিরে এত কাঁপছিস কেন, এবার অনেকদিন পর এলি...সব ঠিক আছে তো!”
ঠাণ্ডা একটা শিহরন সত্যিই দরজা বয়ে ঘরে আসছিল। রাঘব সেটি বন্ধ করে এগিয়ে আসে। আবার বলল...
“এত ঠাণ্ডা লেগেছে!”
“বলিস না, গেছিলাম এক জাগায়, আসতে আসতে বডি প্রেসার কমে গেছে বোধহয়...” মিহির হাসল।
বেশ বড় করে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে একটা, আবছা অন্ধকার দুনিয়ায় সামান্য আলো ঝলকে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোর আকাশ ফাটা শব্দে কেঁপে উঠল সারা ঘর। মিহির স্বভবতই মিশুকে, খুবই অল্পসংখ্যক চেনাজানার মধ্যের একজন, অই...পুরনো বন্ধু বলা যেতে পারে। তাই সে হটাত এসে জোটায় রাঘব সামান্য অপ্রস্তুত। মিহির সোফায় বসেই বলল...
“যদি কিছু মনে না করিস, তোর সোফাটাতেই একটু শুতে পারি রে...”
“তা... আর বলার কি, নে শো...”
মিহির বসে বসেই জুতো আর জ্যাকেট খুলে সোফার ওন্য পাশে রাখতে যাচ্ছিল কি এমন সময় কিছু একটা পরার শব্দ হল হটাত, তাও আবার রাঘবের পায়ের কাছেই। হুরমুরিয়ে মিহির সেটা কুঁড়াতে যাচ্ছিল কি রাঘব উঠিয়ে ধরল সেটা।
“বাঃ দারুন তো, এক্‌সেলেন্ট কারুকার্য তো, কোথায় পাস রে এসব, লাইফে ফার্স্টটাইম দেখছি... এ জিনিসে এমন কাজ...”
রাঘবের হাতে নক্সাকরা, ভালোকরে বললে নক্ষত্রখচিত বেশ সুন্দর একটি ছুরি। বেশ ভাল করে দেখে এগিয়ে ধরল মিহিরের সামনে... “নে ধর...সামলে রাখিস এটা, বেশ দাম হবে মনে হচ্ছে... পুরোনোআমোলের রাজা রাজরার সম্পত্তি নিকি রে!” বলে হাসি মুখে আর একবার ভাল করে দেখল সেটা।
“হু...হবে হয়ত...এক বন্ধু দিল আর কি” রাঘবের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিজে একবার দেখে মিচ্‌কি হাসে মিহির।
“কোথা থেকে আসা হচ্ছে তোর এত সকাল সকাল, বাপরে স্যুট্‌ বুট্‌ পরে, অতবড় ব্যাগ নিয়ে... কোথাও যাচ্ছিস না আসছিস?”
একাএক এমন প্রশ্নে চম্‌কে ওঠে মিহির। সে অনবরত কথা বলতে পারে, কিন্তু আজ জানি তার কি হয়েছে, মনে হচ্ছে ওর মাথা কোথাও আছে আর মন কোথাও। কালো লেদার ব্যাগটা সোফার এক পাশেই ছিল, মিহির সেটাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল “না... যাবার, মানে আমি... শহর ছাড়ছি”
“শ...হ... মানে!!!”  
“অনেক তো হল রে এ শহরে, তোর তো তথাপি কিছু একটা হিল্লে হল, চাকরী করছিস, আর আমি তো ফিউস্‌। এবার একটা চান্স যখন পেয়েছি আর...” বলতে বলতেই থেমে গেল মিহির।
“চান্স! মানে!কি জিনিস!কি পেলি রে...” উতগ্রিব রাঘব নিজেও একটা ভাল সুযোগের জন্য হন্যে হয়ে অপেক্ষা করছে, মিহিরের কথায় সেও তাই আগ্রহী হয়ে উঠল।
“আরে না...মানে ভাগ্যপরীক্ষা আর কি” মিহির সামান্য হোচট্‌ খায়, নিজেকে সামলিয়ে সোফা থেকে উঠে বসে সে। রাঘবও তার পাসে এসে বসে।
“চান্সের সঙ্গে ভাগ্যপরীক্ষার কি সম্পর্ক!একটু ঝেরে কাশ না ভাই...”
“আছে...বৈকি।মানে...”
 “কিছু নিশ্চিত পেয়েছিস তুই...ফরেন এ কিছু হল কি, ভাগ্য করে পেলে আমাকেও একটু ভাগ্যে জুটিয়ে দিস ভাই...”
“ না না না... তেমন কিছু নয়... কাজ হয়ে গেছে... সময় এলে...পরে...”
বাকিটা বলতে যাবার আগেই আকাশে বাজ পরার মত ডোর বেলটা বেজে উঠল। আরেকবার বাজল, আবার বাজল। এত রোমাঞ্চিত আসোর ভেঙ্গে যাওয়ায় রাঘব দরজায় দন্ডায়মান সেই মহান মানুষটিকে রুচিশিক্ষা দেবে বলে ক্ষিপ্রবেগে দরজার দিকে এগিয়ে আসছিল, অমনি একলাফে নেমে দৌরে এগিয়ে গেল মিহির হাতের কালো ব্যাগটাকে সোফার নীচে ফেলে। বড় বড় চোখ করে অস্ফুট বলে ওঠে “...সর্বনাশ!”

রাঘব হতভম্ভঃ, অবাক, নিস্পলক, মিহিরের দিকে চেয়ে আছে।আবার কলিং বেল, আবার, আবার...। মিহির দুহাত দিয়ে জাপটে ধরল রাঘবকে রাঘব! সর্বনাশ! ...পুলিশ!
“কি...পুলিশ!”
আশ্চর্য রাঘব তবুও দরজা খুলবে বলে এগচ্ছিল...আবার ঘনঘন বেল বেজেই চলছিল।
“না না...খুলিস না...ওরা আমাকেই বোধহয়... শোন শোন তুই বলবি নেই...নেই, বুঝলি তো...”

রাঘব হতবাক হয়ে গেছে মিহিরের কথায়।তার চোখে হাজার প্রশ্ন।


                                                                        আসছে...