Adekha Upakhyan - অদেখা উপাখ্যান - Story Chapter-2
অদেখা উপাখ্যান
(Adekha Upakhyan-Story)
(২)
দিয়েছিল এই বলে যে আলোকই বড় হয়ে তাদের জীবনে আলো জ্বেলে দেবে। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বোনদের বিয়ে দেবে, স্বপ্নমণ্ডিত আকাশে বিচরণ করাবে তাদের। এই সুবর্ণ স্বপ্নকে দুরের আকাশে দেখতে পেয়ে প্রথম ঘোষাল তাঁর ছেলেকে স্বস্নেহে, স্বযত্নে পড়াশুনার হাতে-খড়ি দিলেন। তবে অজানিতে কেবা হাসে তাঁর এসব কান্ড দেখে, যেন ঠিক তারপরেই অথৈ জলে পরে গেল তাঁর পরিবার। পরিবার বিভাজন নিজেদের মধ্যে এক ক্লেশময় সম্পর্কের সৃষ্টি করল। তৈরি হল এক অকল্পনীয় পরিস্থিতির। ভাগ্য তাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বেড় করে দিল তাঁর পৈত্রিক বাড়ি থেকে, ভিটাচ্যুত হলেন স্বপরিবার। তাঁর ভাইদের ব্যাবহার আর সেই আইনের নাছোড়বান্দা প্যাঁচগুলো বুঝতে না পেরে সর্বস্বান্ত হল প্রথম ঘোষাল। বাড়ি থেকে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হল শেষমেশ এবং সেখান থেকেই শুরু হল তাঁর আত্মান্বেষণের কাহিনী। তাঁকে পারতেই হবে, এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। এই নতুন পরিস্থিতিতে একমাত্র সম্বল তাঁর চাকরিটি আর আশার ফসল তাঁর ছেলে। যেভাবেই হোক আলোককে মানুষের মত মানুষ তৈরি করতেই হবে তাঁর। সব সম্পর্কের মুখে ছাই চাপা দিয়ে এগিয়ে গেল নতুন উদ্যমে নিজ পারিবারকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে। পরিবারকে নিয়ে গড়ে তুললেন নতুন বাসস্থান। ছেলের পড়ার খরচ যোগালেন নির্দিধায়, ধার দেনার সাগরে নামিয়ে দিলেন নিজের সংসারকে। হয়ত ভগবান তাঁর পানে মুখ তুলে চেয়েছিলেন, তাঁর পরিশ্রমের সাথী হয়েছিলেন যাতে তিনিই জয়ী হোন। শারীরিক, মানসিক ভাবে খেটে তাঁরও প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে, তারুণ্যের ছল-ছল চোখে আলোক যখন এগিয়ে দেয় তার মাধ্যমিকের ফার্স্ট ডিভিশন আর চারটি লেটারের মার্কশিট আর স্কুল প্রদত্ত প্রশংসা পত্র। তাঁরও নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে, অন্তর গর্ব করে ওঠে, বুঝতে পারেন একাংশও হারেনি তাঁর চেষ্টা। অশ্রু বাঁধ ভেঙ্গেছিল তাঁরও, গোটা পরিবারই আনন্দের অশ্রুতে ভেসেছিল সেদিন। তারপরও এমন দিন আরও এসেছিল, প্রথম ঘোষালের বুকের উচ্চতা তখন কে দেখে। তবে, ছেলের টিউশিনির জোগান দিতে গিয়ে বাড়ির এককোনে মেয়েদের পড়াশুনা তেমন ভাবে আর চলে না, তারা অবহেলিত হয়ে পরে। পড়াশুনায় জোর না পরায় তারা তাদের দাদার মত ফার্স্টের পর্যায় আসতে পারে না। এটা তাদের দোষ নয়, ওরা যে যথাসাধ্য চেষ্টা করে এটাই তাদের সিমিত আয়ের পরিবারের জন্য অনেক। এর চেয়ে আর কিই বা দিতে পারে এই পরিবারকে আপাতত। দাদা একটা চাকরি পেলেই তো স্বপ্ন রঙ্গীন হয়ে যাবে মুহুর্তে। বাবার তো এখনও উপার্জন চলছে, দাদার একটা কিছু হলেই একেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে যাবে তাদের পরিবার। তাই তো আনন্দের স্বপ্নে মসগুল সকলে।
সত্যিই, সময়ের সাথে সাথে সে এক দারুন ছেলে হয়ে উঠেছে, যেমন চেহারা তেমনি
স্বভাব-চরিত্র, আর তেমনি শিক্ষা। একে একে পরীক্ষার সব গণ্ডিই অবলীলায় উতরে গেল
আলোক। প্রতিবারই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকেই সে আপ্লুত করতে সক্ষম হয়েছে, তার
একান্ত সাধনার ফসল ফলিয়ে। তার হাতের ফাইলটি এখন সম্পদে ভরপুর, বহু কষ্ট করে পাওয়া
এসব তার যখের ধন। এক একটি সার্টিফিকেট দেখবার মতন। এখন এসবের মুল্যায়নের পালা।
সব্বাই তার পানে চেয়ে, এবার হয়ত তাদের অপেক্ষা শেষ হবে, এবার হয়ত ভাগ্য মুখ তুলে
চাইবে।
ফাইল নিয়ে আলোক বেড়িয়ে পরল বিশ্বজয় করতে, ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠল যে একটা
ভাল চাকরি চাই। কিন্তু বাজার যে এত ব্যাস্ত, এত জনবহুল, তার জানা ছিল না। ফর্ম
ভরতে ভরতেই কলমের কালি তার শেষ হয়ে এল। এমপ্লয়মেন্ট নিউজের দাম বাড়তে বাড়তে আন-এমপ্লইদের
মাথার আরও এক যন্ত্রণা হয়ে দারালো। যেন কাগজের বাড়তি মূল্য ব্যালেন্সের জন্য
একমাত্র বেকাররাই টার্গেট। সাথের অনেকেই চাকরি পেল, কেউ পৈত্রিক ব্যাবসায় আর কেউবা
গেল বিদেশে। অনেক কিছুই বদলে গেল, কিন্তু আলোকের চাকরি হল না।
এদিকে, প্রথম বাবুর চাকরির মেয়াদ এই ফুরোলো বলে। এতোগুলো এতকষ্টে উপার্জিত
সার্টিফিকেটের কোন মূল্যই পাওয়া যাচ্ছেনা এই ব্যাস্ত জনবহুল মহাসমুদ্রে। রাস্তায়
নামলেই যেন কত সহস্র আলোককে দেখতে পাওয়া যায়, তার হিসেব রয়েছে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের
জমাবদ্ধ খাতার কালো অক্ষরে। আর সেই সংখ্যা দিন কে দিন শুধুই বাড়ছে। ন-টার রাস্তা
তো জনবহুল, ঘুরে ফিরে একি প্রশ্ন বারবার মনে আসে – ‘কত মানুষ তো চাকরি পায়, তারা
কি সবাই তাদের ক্লাশের খাতায় একশ শতাংশ নম্বর পেয়েছে! আচ্ছা, সবারই কি সব কাজের
এক্সপেরিয়েন্স আছে! তবে তারা ইন্টারভিউতে গেলেই সিলেক্ট হয়ে যায় কিভাবে!’ জানতে
খুবই আগ্রহী আলোক। রাস্তার ট্রাফিক পয়েন্টের তলায় দাঁড়ালেই আশে পাশে কত অফিস ঘিরে
ফেলে তাকে। প্রাত্যহিক কত লোক চাকরি করে এসব অফিসে, কলকারখানায়। সবাই পায় আর শুধু
তার বেলাতেই নেই। সংবাদপত্র ওলটালে তো মনে
হয় যেন চাকরি হরিলুটের বাতাসা, কিন্তু বাতাসার বুকে যে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের নাম
বসানো, তার খবর আগে জান্ত না সে। আলোক এ পৃথিবীর জটিলতায়, সংসারের প্রতি দায়িত্ববোধের
আচমকা আবির্ভাবে দিশেহারা হয়ে পরে। বাড়িতে প্রায়ই পাওনাদারদের ভীর, তাদের চোখ
রাংগানি মনোভাব, মস্তিষ্কে এক চরম বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, তাকে রুক্ষ করে তোলে।
মাঝরাত পর্যন্ত মা’য়ের সাথে তার বাবা’র নিচুগলার আলোচনা, তাকে আরও সন্ত্রস্ত করে
তোলে। সে ভয় পায় অদূর ভবিষ্যতের পরিণামকে কল্পনা করে। তার বোনেদের চোখে আশাভঙ্গের
স্পষ্ট ছাপ দেখতে পায় সে। ভয়ে থরথর কেঁপে ওঠে বাবার ক্লান্ত মুখখানা দেখলে। ক’দিন
বাদে রিটায়ার করবেন তিনি, তারপর! এক বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় সে। ঘরের বাইরের
জগতটা যে এতটা প্রফেশনাল, এতটাই প্র্যাক্টিকেল, এতটাই যে স্কুলের বই’য়ের
চিন্তাধারার উলটো, তা সে আন্দাজ করতে পারেনি। জীবনের এতটা পর্যন্ত বই’য়ের জগতটাকেই
সমরূপ দুনিয়ার নিয়ম ভেবে তাতেই মন্ত্রমুদ্ধের মত এতটাই আবদ্ধ হয়েছিল যে, আজ এ
দুনিয়ার নিয়ম কানুন তার কাছে যেন অচেনা ঠেকছে। বার বার তার মনে হচ্ছে যেন সে
পিছিয়ে পরছে জীবনের দৌড়ে। ‘নিজেকে অপদার্থ বলে মনে হচ্ছে...’ বাড়ির ভিতরে ঢুকলেই
নিচু হয়ে যায় তার মাথা। এতগুলো সার্টিফিকেট, বাক্সবন্দী করে রেখেছে – ‘এর চেয়ে দুর্ভাগ্য
কি আর হতে পারে...’ বাড়িতে দু-মুঠো খেতে পর্যন্ত তার বুকে বাঁধে, বাবা-মা’য়ের চোখে
চোখ রাখতে হীনবোধ হয়। মনে হয় সে যেন এই পৃথিবীর জঞ্জাল মাত্র। হন্যে হয়ে ঘুরেও
একটা চাকরির জোগার করতে পারলনা সে। ‘অত্যন্ত হীনশ্রেণীর কাপুরুষ যে নিজের পরিবার
থেকে কেবল নিতেই শিখেছে, দিতে পারেনি এক কনাও কোন সুখ...’
রাস্তায় নামলে, আলোক আর আজকাল চোখে দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। কোথায়
যাবে, কি করবে, কার পদতল লেহন করলে একটা চাকরি পাওয়া যাবে, তার সংসারটাকে শেষমেশ
রক্ষা করতে পারবে। কি করে বাবা-মা-বোনেদের মুখে যতসামান্য হলেও হাসি ফোটাতে পারবে।
ভাবতে ভাবতে সমস্ত শরীরটা তার থরথর করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। হাতের ফাইলটা বুকে চেপে
ধরে হাউ-হাউ করে কেঁদে ওঠে সে... সমস্ত পৃথিবীটার একেবারে বিপরীতে যেন দাঁড়িয়ে আছে
সে, একদম একা। তাকে মনে হচ্ছে, সাহায্য করতে কেউই এগিয়ে আসছেনা, আসবেও না। কানে
বেজে ওঠে, যেন কেউ বলছে... এ পৃথিবীতে দুর্বলদের কোনও স্থান নেই, দুর্বলেরা মিশে
যাবে রাস্তার ধুলোয়। আলোক যেন নিজেকে সেই দুর্বলই ধরে নিয়েছে। তার মগজ আর তার
অধীনে নেই। জিগীষাবৃত্তি তার লোপ পাচ্ছে দিন পর দিন। সংসার-মানুষ-জন, সব থেকে
পালাতে পারলে সে বাঁচে। এই জগতের ভয়াবহ চক্রভুজে ফেঁসে হাজারের মত, হাজার এক
ভুক্তভোগী হয়ে গেল সে। তারপর দিশেহারা পথিকের মতই তার আপন-পরের সব আশা আকাঙ্ক্ষার
আহুতি দিয়ে নিজের বাঁচবার পথ বেঁচে নিল। তার আশায় যারা বসে থাকত, যে পরিবার তাকে
নিয়ে সোনার স্বপ্ন দেখেছিল, রেখে গেল তাদের জন্য নিজের নিষ্প্রাণ ঝুলন্ত দেহ।
...এই শেষ, সমাপ্তি হয় আলোক অধ্যায়ের, আর তার সাথেই আছড়ে পরে অনেক অনেক স্বপ্ন।
পৃথিবীর বুকে ছেড়া কাপড়ের মত লুটিয়ে পরে আশার সিংহাসনচ্যুত তার সেই পরিবারটি,
আলোকের পরিবারটি। এমন ভূমিস্খলনে নড়ে উঠল ঘরের প্রাচির, তার ভেতরের প্রাণীরা, উন্মাদ
হয়ে গেল সেই আশার স্রষ্টা- আলোকের মা।
চলবে...
Post a Comment